
সাম্প্রতিক এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে সৌরজগতের প্রায় শেষ প্রান্তে, প্লুটোরও বহু দূরের এক রহস্যঘেরা অঞ্চলে, নতুন এক বামন গ্রহের খোঁজ পেয়েছেন একদল গবেষক। এই নতুন গ্রহটি কুইপার বেল্টের বাইরেও আরও গভীরে, এমন এক অঞ্চলে অবস্থান করছে যেখানে আলো-তাপমাত্রা প্রায় নেই বললেই চলে, আর মহাকর্ষের টানও সেখানে একেবারেই দুর্বল। তীব্র শীতল ও অন্ধকার এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহটি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে গভীর কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
এই ছোট্ট বামন গ্রহের ব্যাস মাত্র ৭০০ কিলোমিটার বা প্রায় ৪৩৫ মাইল, যা সাধারণ গ্রহগুলোর তুলনায় অনেক ছোট। কিন্তু তার অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো এর অত্যন্ত উপবৃত্তাকার (elliptical) কক্ষপথ। ‘২০১৭-এর ২০১’ নামে নামকরণ করা এই বামন গ্রহটি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় প্রায় ২৫ হাজার বছর! অর্থাৎ এর এক বছরের সমান আমাদের পৃথিবীর ২৫ হাজার বছর।
এর সূর্য থেকে দূরত্ব এতটাই বিশাল যে, কক্ষপথের নির্দিষ্ট কিছু অংশে এসে এটি সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের ১ হাজার ৬০০ গুণ বেশি দূরে অবস্থান করে। এরকম দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার কারণে এর কক্ষপথ, গতি এবং মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিজ্ঞানীদের কাছে এক রহস্যময় বিষয় হয়ে উঠেছে।
এই অভাবনীয় আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনের ‘ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি’-এর গবেষক সিহাও চেন এবং তাঁর গবেষক দলকে। তাঁরা ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভিক্টর এম. ব্লাঙ্কো টেলিস্কোপ এবং কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা ১৯টি সংরক্ষিত চিত্র বিশ্লেষণ করে উন্নত প্রযুক্তি ও অ্যালগরিদমের মাধ্যমে এই বামন গ্রহের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
এই আবিষ্কারের পর সিহাও চেনের দল আরও বিস্তারিত গবেষণার জন্য ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, হাবল টেলিস্কোপ এবং অত্যাধুনিক আলমা রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রহটির আকৃতি, পৃষ্ঠতলের গঠন, বায়ুমণ্ডলের উপস্থিতি এবং সম্ভাব্য উপগ্রহ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা।
বিজ্ঞানীদের মতে, এই বামন গ্রহের আবিষ্কার কেবল একটি নতুন গ্রহ যুক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এটি সৌরজগতের কাঠামো এবং এর সীমা সম্পর্কে প্রচলিত সব ধারণাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এটি আমাদের সৌরজগতের গভীরতম অংশগুলোর অজানা অধ্যায়ের পর্দা উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে গ্রহ, উপগ্রহ এবং নক্ষত্রের মধ্যে মহাকর্ষ বলের আন্তঃক্রিয়া এবং সৌরজগতের প্রসারিত সীমানা সম্পর্কে গবেষণাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এই আবিষ্কার।
এই ঘটনাকে গত এক দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ গবেষণা হিসেবেও অভিহিত করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, ২০১৭-এর ২০১-এর মতো এমন একটি বামন গ্রহের অস্তিত্বের প্রমাণ ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানে, সৌরজগতের গঠন কাঠামো বোঝায় এবং এমনকি আমাদের কল্পনার বাইরের সম্ভাব্য বসবাসযোগ্য অঞ্চল খুঁজে পেতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
এই নতুন গ্রহের আবিষ্কার ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। বিজ্ঞানীরা একে সৌরজগত সম্পর্কে গবেষণার এক নতুন অধ্যায় বলে মনে করছেন, যা ভবিষ্যতের মহাকাশ বিজ্ঞান ও গবেষণার জন্য এক অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।