মহাবিশ্বের উৎপত্তি, প্রসারণ, এবং শেষ প্রান্ত নিয়ে মানুষের মনে চিরকালই প্রশ্ন থেকে গেছে। আমাদের আশেপাশের এই অসীম মহাকাশে কীভাবে সবকিছু শুরু হলো, তার শেষ কোথায়—এমন অসংখ্য জিজ্ঞাসা উত্তরহীন রয়ে গেছে। সম্প্রতি এই গভীর প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথে নতুন এক আবিষ্কার আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) মহাবিশ্বের প্রান্তে থাকা রহস্যময় রেড মনস্টার গ্যালাক্সি নিয়ে এমন কিছু তথ্য উন্মোচন করেছে, যা মহাজাগতিক তত্ত্বে নতুন ধাঁধার সৃষ্টি করেছে।
১২.৮ বিলিয়ন বছরের পুরোনো ছায়াপথ
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সম্প্রতি মহাবিশ্বের শুরু থেকে প্রায় ১২.৮ বিলিয়ন বছরের পুরোনো তিনটি দৈত্যাকার গ্যালাক্সির ছবি তুলেছে। এদেরকে বলা হচ্ছে রেড মনস্টার গ্যালাক্সি। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এই গ্যালাক্সিগুলোর আকার আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির প্রায় সমান, যা মহাবিশ্বের উৎপত্তি বলে ধরা হয় বিগ ব্যাং-এর সময় থেকেও ১ বিলিয়ন বছর পুরোনো।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের উৎপত্তি প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে হয়। এটি এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের গঠন ও বিকাশ নিয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। কিন্তু যদি বিগ ব্যাং-এর আগে থেকেই এত বিশাল গ্যালাক্সি থাকে, তাহলে মহাজাগতিক সময়রেখা ও আমাদের বিদ্যমান ধারণায় বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
প্রচলিত তত্ত্বের চ্যালেঞ্জ
সর্বাধিক গৃহীত মহাজাগতিক মডেল, যা ল্যাম্বডা কোল্ড ডার্ক ম্যাটার (LCDM) নামে পরিচিত, তা অনুযায়ী মহাবিশ্বে গঠিত প্রথম দিকের গ্যালাক্সিগুলো এত বিশাল হওয়া অসম্ভব। কিন্তু রেড মনস্টার গ্যালাক্সিগুলোর বিশাল আকার এবং উচ্চ ধূলিকণা এই মডেলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টেজেন উয়েটস বলেছেন, “এ ধরনের তিনটি গ্যালাক্সির অস্তিত্ব আমাদের প্রচলিত তত্ত্বে বড় ধরনের ধাঁধা সৃষ্টি করেছে।”
এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আরও ছয়টি গ্যালাক্সির সন্ধান পায়, যেগুলো বিগ ব্যাং-এর মাত্র ৫০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন বছর পর গঠিত হয়েছিল। এগুলোর আকারও ধারণার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি।
রেড মনস্টারের রহস্য
রেড মনস্টার বা লাল দৈত্য নামে পরিচিত এই ছায়াপথগুলো তাদের উজ্জ্বল লাল রঙ এবং গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আলাদা। জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী মেনগুয়ান জিয়াও মনে করেন, এই গ্যালাক্সিগুলো মহাবিশ্বের প্রাথমিক গঠন নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে।
যদিও অনেক গবেষক এই আবিষ্কারকে বৈপ্লবিক বলে মনে করছেন, কেউ কেউ এটিকে “অযৌক্তিক দৃষ্টিভ্রম” বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে নতুন এই পর্যবেক্ষণ মহাবিশ্বের জন্ম এবং এর বিকাশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ধারণাগুলোর ওপর আলো ফেলেছে।
মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে আরও কী লুকিয়ে আছে?
রেড মনস্টার গ্যালাক্সিগুলো আমাদের বোঝার বাইরে থাকা মহাবিশ্বের অজানা অধ্যায় উন্মোচনের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মহাকাশ গবেষণা প্রতিনিয়ত আমাদের জানার সীমা বাড়িয়ে দিচ্ছে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মতো উন্নত প্রযুক্তি মহাজাগতিক ইতিহাসের গভীরে পৌঁছে আমাদের অস্তিত্ব এবং এর শুরুর প্রশ্নে নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।
মহাবিশ্বের বিস্তৃতি নিয়ে এই অজানা অধ্যায় একদিকে যেমন রহস্যময়, অন্যদিকে তা গবেষণার অবারিত সুযোগ তৈরি করছে। বিগ ব্যাং-এর সময়সীমার আগে এই রেড মনস্টার গ্যালাক্সির অস্তিত্ব ভবিষ্যতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন তত্ত্ব ও আবিষ্কারের পথ খুলে দিতে পারে।
আরও পড়ুন
ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করবে অক্টোপাস
মঙ্গল গ্রহে নতুন বছরের শুভেচ্ছা: লাল গ্রহের অনন্য উদযাপন