
শনি গ্রহের সবচেয়ে বড় চাঁদ টাইটান নিয়ে নতুন ও চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেছেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, এই রহস্যময় চাঁদের হ্রদে এমন এক ধরনের গঠন তৈরি হতে পারে, যা প্রাণের গোড়াপত্তনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, টাইটানের হ্রদে স্বাভাবিকভাবেই গঠিত হতে পারে ভেসিকেল—এক ধরনের কোষসদৃশ গঠন, যা জীবনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই গবেষণাটি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাস্ট্রোবায়োলজি-তে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, টাইটানের হ্রদগুলো ইথেন ও মিথেন নামক তরল হাইড্রোকার্বনে পূর্ণ, যেখানে জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক কাঠামো ও উপাদানগুলো বিদ্যমান রয়েছে।
টাইটানের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর মতো নয়, বরং অনেক ঘন এবং এতে প্রধানত নাইট্রোজেন ও মিথেন রয়েছে। সেখানে তাপমাত্রা এতই কম যে পানি বরফের মতো জমে থাকে, কিন্তু হাইড্রোকার্বনগুলো তরল অবস্থায় থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই পরিবেশে অ্যাম্ফিফিল অণু নামের বিশেষ অণুগুলো একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে গঠন করতে পারে দ্বিস্তরীয় পর্দা, যা পৃথিবীর জীবকোষের গঠনের সঙ্গে মিল রাখে। এই দ্বিস্তরীয় গঠনই তৈরি করে ভেসিকেল, যা প্রাণের সূচনাপর্বে কোষের বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের গবেষক ড. কনর নিক্সন জানান, “টাইটানে ভেসিকেলের অস্তিত্ব থাকাটা একেবারে অসম্ভব নয়। আমরা জানি, প্রাণের উৎপত্তির জন্য যে ধরণের জৈবিক কাঠামো প্রয়োজন, টাইটানে তার উপস্থিতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই নতুন গবেষণা আমাদের প্রাণের খোঁজে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করতে সাহায্য করবে।”
বিজ্ঞানীরা আরও ধারণা করছেন, যখন টাইটানে মিথেনবৃষ্টি হয়, তখন সেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হ্রদ ও সমুদ্রের পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই তরল হাইড্রোকার্বনের সংস্পর্শে ভেসিকেল গঠনের পথ তৈরি হতে পারে। এতে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। যদি টাইটানের মতো এক বরফ-আবৃত জগতে প্রাণের গঠন সম্ভব হয়, তাহলে মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে যাচাই করার লক্ষ্যেই নাসা টাইটানের উদ্দেশ্যে পাঠাচ্ছে ড্রাগনফ্লাই (Dragonfly) নামের এক অত্যাধুনিক রোটারক্রাফ্ট যান। এটি টাইটানে পাঠানো নাসার প্রথম সরাসরি অভিযান, যার মূল লক্ষ্য হলো টাইটানের পৃষ্ঠভাগ অন্বেষণ এবং সেখানে প্রাণের সম্ভাব্য উপাদান ও পরিবেশ বিশ্লেষণ করা। এই ড্রোনটি উড়ে উড়ে টাইটানের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করবে, মাটির গঠন ও রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করবে এবং প্রাণের সম্ভাব্য নিদর্শন অনুসন্ধান করবে।
নাসার এই গবেষণা ও উদ্যোগ কেবল টাইটানেই নয়, বরং পুরো মহাবিশ্বে প্রাণের খোঁজকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। প্রাণের উৎপত্তি শুধুই কি পানির ওপর নির্ভরশীল? নাকি অন্য কোনো তরল মাধ্যমেও প্রাণের সূচনা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন, আর টাইটান হতে পারে সেই রহস্যভেদের এক নতুন চাবিকাঠি।
এখন বিশ্বের চোখ টাইটানের দিকে। ভবিষ্যতে টাইটান হয়ে উঠতে পারে প্রাণের বিকাশের সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঠিকানা—এই ভাবনাই আজ বৈজ্ঞানিক কল্পনার গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।